07-07-2021
গল্পের শুরুটা ১৬২৬ সালের দিকে সুইডেনের রাজা গাস্তভাস এডল্ভাস, তিনি একটা যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণের আদেশ দেন কারণ তখন কার সময় জলদস্যু দের হাত থেকে বাঁচবার জন্য চিন্তা করতে হতো। তখন জলদস্যুদের কথা মাথায় রেখে সুইডিশ নেভির জন্য বানানো হলো “ভাসা” যা ছিল তখন কার যুগের ফ্লাগশিপ জাহাজ।
অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে এটা ছিল তখনকার দিনের অন্যতম দর্শনীয় জাহাজের একটি কারণ এই জাহাজ তখনকার দিনের সেরা সেরা কাঠের কারিগরদের তৈরী কয়েক’শ ভাস্কর্য এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম দিয়ে সুসজ্জিত ছিল।
এখানে ব্যাপারটা শেষ হলে ভালো হতো কিন্তু জাহাজটি যদিও তৈরির সময় ৩৪ টি কামান ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ছিল, কিন্তু ১৬২৬ সাল থেকে ১৬২৮ সাল পর্যন্ত এই প্রজেক্ট শেষে এটা সাগরে নামানো হয়েছিল এর দ্বিগুণের মতো কামান দিয়ে। এই দ্বিগুণ সংখ্যক কামানের জন্য আরো অনেক বড় ডেক এবং সরঞ্জামের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এটার মূল ডিজাইনে এরকম বিপুল ওজনের অতিরিক্ত কামান বা সরঞ্জাম কোনোটিই ছিল না। ফলে, “ভাসা” এর প্রথম যাত্রায় এক মাইল না যেতেই স্টোকহোম বন্দরে তলিয়ে যায়।আর সব চাইতে কষ্টের বিষয় হলো তখনকার সময় খরচ হয়েছিল ২ লক্ষ স্প্যানিশ ডলার যা সুইডেনের গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (GDP) এর ৫%।
উপরের গল্প টা “ডিজিটাল ইতিহাস” এর পাতা থেকে নেওয়া; কিন্তু এর সাথে
ফিচার ক্রিপ এর সম্পর্ক কি? কিংবা কেন ডুবে গেল অথবা কেন এত খরচ হলো?
উইলিয়াম লিডওয়েল তার “দ্যা পকেট অফ ইউনিভার্সাল অফ ডিজাইন” বইতে বলেন “ ভাসা নির্মাণের সময় পূর্বপরিকল্পিত ডিজাইনের বাইরে অতিরিক্ত কামান, ডেক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম যোগ করার কারণে জাহাজটির ধারণ ক্ষমতার বেশি ওজন হওয়ায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে ফিচার ক্রিপ কি? ফিচার ক্রিপ হচ্ছে একটি প্রোডাক্টের প্রয়োজন এবং স্কোপ এর বাইরে অতিরিক্ত ফিচার সংযোজন করা, যার কারণে একটি প্রোডাক্ট সম্পদ না হয়ে দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়। এটির কারণে প্রোডাক্ট তৈরিতে ব্যয় বৃদ্ধি এবং ডেডলাইন মিস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এটার আর একটি নাম আছে সেটা হলো “স্কোপ ক্রিপ”।
তাহলে সহজ ভাষায় ফিচার ক্রিপ মানে কি? ফিচার ক্রিপ হল ক্রমাগত ভাবে অরিজিনাল স্কোপ অথবা যা দরকার তার থেকে বেশি ফিচার দিয়ে প্রোডাক্টকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলা।
এখানে উদাহরণ হিসেবে যদি দিতে হয় আর দশটা ডিজাইনারের মত আমি রিমোট কন্ট্রোলের অনেক বাটন কিংবা মাইক্রোসফট অফিসের টপ বারে অনেক এডভান্সড টুলবারের কথা বলবো। উইলিয়াম লিডওয়েলের মতে একটা সময় কিংবা এখনো মার্কেটার, ডিজাইনার কিংবা স্টেকহোল্ডাদের ধারনা “মোর ইজ বেটার ফর ইউজার”।
আমার নিজের একটা উদাহরণ বলি-
আমরা অনেক সময় বৃদ্ধ মানুষকে একটি লাঠি ব্যবহার করতে দেখি। এখন কেউ একজন বললো, চল আমরা বৃদ্ধ মানুষদের কথা মাথায় রেখে হাঠার জন্য এস্থেটিক লাঠি বানাই। ভ্যালিডেশন, প্রবলেম ফাইন্ডিংস, প্রোডাকশন খরচ এবং মার্কেট এনালাইসিস করে একটা লাঠি বানানো শুরু করলাম। কাজ শেষ করার সময় ও নির্ধারণ করা হলো। ডিজাইন করা হলো, এবার ডিজাইন অনুসারে লাঠিও বানানো শেষ। হঠাৎ মনে হল একটা আংটা টাইপ এ্যাড করি, যেখানে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখা যাবে, তো যেই ভাবা সেই কাজ! দিলাম আংটা এ্যাড করে। এবার মনে হল বৃদ্ধ মানুষ পানি খেতে পারে, তাই ছোট একটা পানির বোতল রাখার হোল্ডার থাকলে ভালো হতো! আচ্ছা দিলাম বোতল হোল্ডার এ্যাড করে। দিন শেষে দেখা গেল আমাদের কাজের ডেডলাইন এবং প্রোডাকশন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আচ্ছা তারপরও সমস্যা নেই; যা হয়েছে তাই দিয়ে শুরু করা যাক।
মার্কেটে প্রোডাক্টটি ছাড়লাম। দেখা গেল একজন বৃদ্ধ মানুষ আংটাতে বাজারের ব্যাগ এবং পানির বোতল হোল্ডারে রাখার পর, লাঠি আর উঠাতে পারছে না। দিন শেষ আপনার সব ফিচার গুলো সাফল্যের সহিত মুখ থুবড়ে পড়লো।
উইলিয়াম লিডয়েলের ভাষ্যমতে, অপ্রয়োজনীয় ফিচার এ্যাড করলে তার জটিলতা বাড়ে এবং তার খরচও বেড়ে যায়। ফিলিপ্স ইলেক্সট্রনিক্স একদিন আবিষ্কার করলো তাদের অর্ধেকের বেশি প্রোডাক্ট গুলো কাস্টমার রিটার্ন করেছে। অথচ সেই প্রোডাক্ট গুলোর কোনধরণের টেকনিক্যাল প্রবলেম ছিল না। কিন্তু কেন রিটার্ন করছিল? কারণ কাস্টমাররা বুঝতে পারছিল না যে, কিভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। তার মতে ফিচার ক্রিপ এর বেস্ট কেস হল- কাস্টমাররা অনেক ফিচার পাচ্ছে ঠিক, কিন্তু কিভাবে তারা ব্যবহার করবে সেটা তারা নির্ধারণ করতে পারে না, কিংবা নতুন করে প্রতিদিন শিখতে হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কিভাবে আমরা ফিচার ক্রিপ বিষয়টি ম্যানেজ করতে পারি?
ড্যান ওয়েলসেন এর একটি উক্তি দিয়ে বলা যায় “প্রোডাক্ট ডিজাইনের গোল্ডেন রুল খুব সিম্পলঃ সঠিক ফিচার বাছাই করে, সঠিক মানুষের কাছে দায়িত্বে দিতে হবে।”
ড্যান ওয়েলসেন তার “দ্যা লিন প্রোডাক্ট প্লেবুক” বইতে একটি উদাহরণ দিয়েছেন, সেটা হলো- “সুইস আর্মি নাইফ” ব্যবহার উপযোগী অসাধারণ একটি ছুরি। একই সাথে আপনি এটা দিয়ে অনেক কিছু করতে পারবেন। কিন্তু আমরা যদি একটু অন্যভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখবো, এই ছুরির সাথে আপনি যদি আরও অনেক ফিচার এ্যাড করেন (যেমনটা আমরা চাইনিজ আর্মি ছুরিতে দেখি) তাহলে এটা অনেক মোটা হবে, ভারী হবে এবং এর শক্তি হারাবে। কারণ একটা ছুরির যে ধারণ ক্ষমতা থাকে অথবা তা দিয়ে যা করা যায়, তা একসাথে অনেক গুলো টুলস, ছুরির সাথে যোগ করে নাও করা যেতে পারে। এতে প্রোডাক্টটি তার কার্যকারিতা হারাবে কিংবা হারাতে পারে।
তাই একটা প্রোডাক্ট যেন ফিচার ক্রিপে পরিণত না হয় সেই জন্য প্রোডাক্টের “কোর ফিচারে” নজর দেওয়া উচিত। এটা মনে রাখা উচিত, ফিচার ক্রিপের সাধারণ কারণ হলো খারাপ ব্যবাস্থাপনা, ভুল সিদ্ধান্ত এবং সঠিক ব্যাক্তিকে কাজ না দেওয়া। এর জন্য কিছু বিষয়ে ফোকাস দেওয়া উচিত।
১। আপনি ইউজার কিংবা মার্কেট রিসার্স করে আপনার ইউজার নির্ধারণ করে, তাদের চাহিদা এবং তাদের দরকারগুলোর লিস্ট করে সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফিচারগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন।
২। প্রোডাক্ট নির্মাণের সময় রোডম্যাপ তৈরি এবং সেই অনুসারে কাজ করা উচিত। ইউনিভার্সাল একটা উক্তি রয়েছে “শেষ যদি ভালো চাও, শুরুটা ভালো ভাবে করো”! তাই শুরুতেই নির্ধারণ করা উচিত কি কি করা হবে, কিভাবে করতে হবে এবং তা কত দিনের মধ্যে।
৩। না বলতে শিখুন। যদিও আমার কাছে এটা খুব কষ্টের, তবুও এটা খুব দরকার।
“ স্টিভ জবস বলেছিলেন “মানুষ মনে করে ফোকাস অর্থ হচ্ছে তাকে যে বিষয়টিতে মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে, সে বিষয়ে হ্যাঁ বলা। কিন্তু এর অর্থ উল্টো। এর অর্থ হচ্ছে অন্যান্য হাজারো ভাল আইডিয়াকে বিদায় জানানো। তবে এ কাজটি আপনাকে সতর্কভাবে করতে হবে। আমরা যে কাজগুলো করেছি, সেগুলোর জন্য আমি যতখানি গর্বিত, যে কাজগুলো করিনি সেগুলোর জন্যও আমি ঠিক ততোখানিই গর্বিত। উদ্ভাবন মানে হচ্ছে হাজারটা বিষয়কে না বলতে পারা।”
তাই এক জন প্রোডাক্ট ম্যানেজারের একটা শক্তিশালী স্কিল হলো না বলতে পারা। তাই যখন পরিকল্পনার বাইরে কোন ফিচার এর অনুরোধ আসলে সেটাকে না বলুন।
৪। ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। এটা ছোট বেলার পুরানো প্রবাদ হিসেবে আমরা জানি। যেটা বাজার করে বাসায় আসার পর আমার প্রায়ই মনে হয়। ভেবে কেনা উচিৎ ছিল! ঠিক তেমনি কোন প্রোডাক্ট বানানোর আগে ভাবুন, যেন আপনার সময় এবং অর্থ বিসর্জন দিতে না হয়।
এরিক রাইস তার বিখ্যাত “দ্যা লিন স্টার্টাপ” বইতে বলেছেন “আপনি এমন একটা জিনিস বানালেন যেটার কোন ব্যবহারকারী নেই। সেক্ষেত্রে আপনার সময় এবং অর্থের মূল্য কি?”
কোনটা ফিচার নিড আর কোনটা ফিচার ক্রিপ, এটা দেখেই বুঝে ফেলবেন এমন কোন জাদুমন্ত্র নেই। কারণ এটা বুঝতে একটু সময় লাগে। কিন্তু এটার ঝুঁকিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিস (KISS- keep it simple, stupid) প্রিন্সিপাল ভালো একটা পদ্ধতি হতে পারে।
মনে রাখতে হবে, সিম্পল জিনিস ইউজারদের জন্য যেমন ভালো, তেমনি প্রোডাক্টের জন্যও উপকারী। একটা প্রোডাক্টের মূল ফিচারগুলোকে সিম্পল করে এগিয়ে যেতে পারলে সময় ও অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হয় এবং কার্যকরীতাও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
আমি আমার মত করে যথাসাধ্য বুঝাতে চেষ্টা করেছি…………। আশা করি আপনার মূল্যবান মতামত দিবেন। আজ চলে যাচ্ছি তো যাচ্ছি না, আবার লেখা হবে। :p
এই লেখাটি লিখতে যারা সাহায্য করেছে তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
Source:
1. The pocket universal principles of design — Book
2. The Lean Startup — Book
3. About Vasa Ship — https://en.wikipedia.org/wiki/Vasa_(ship)
4. https://www.chargify.com/blog/feature-creep/
Have an idea or just want to connect?
RISAT RAJIN © 2025
Designed by me, powered by ✦ Droip