09-16-2021
জ্যাকের সাথে আমার প্রথম পরিচয় কলেজে পড়ার সময় এক তাস খেলার আসরে। তবে তাকে শুধু দেখেই গিয়েছি, কথা হয় নি। তারপর জানলাম এর বাংলা নাম “গোলাম”। গোলাম হলো প্রজা কিংবা আমজনতা টাইপ মানুষ শ্রেণী। আর এই গোলাম যখন সর্বেসর্বা হয়, মানে অনেক গুলো স্কিলসেটে পারদর্শী কিংবা একের অধিক বিষয়ে খুব ভাল বিস্তৃত জ্ঞান রাখেন তখন তাকে বলা হয় “জ্যাক অফ অল ট্রেড”। এটা মূলত একটা ইংরেজি ফ্রেইজ।
এখন এই ব্যাপারটার সাথে প্রোডাক্ট ডিজাইনের সম্পর্ক কি? আমার আগের লেখা ফিচার ক্রিপ: একটি প্রোডাক্ট ধ্বংস করার প্রক্রিয়া! -তে অনেক ফিচার এ্যাড করতে থাকলে কিভাবে একটি প্রোডাক্ট ধ্বংস হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরী হয়, তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আর আজকে আমরা কথা বলবো এটার পজিটিভ বিষয় নিয়ে।
“ফ্লেক্সিবিলিটি-ইউজেবেলিটি ট্রেডঅফ” এর সংজ্ঞা দেবার আগে একটি প্রচলিত উদাহরণ দেই, গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শেষের দিকে বিমান বাহিনীর F-16, A-10, নৌবাহিনীর F/A-18 এবং মেরিন হ্যারিয়ারকে জেট ফাইটার গুলোর ফিচার একত্র করে একটি জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার বানানোর চিন্তা করা হয়েছিল। এখন উপরের এই প্লেনগুলোর বিশেষত্ব কি?
১। বিমান বাহিনীর F-16: এর প্রধান বৈশিষ্ট্য আকাশে যুদ্ধ করার জন্য কিংবা শত্রুর বিমানের পিছু নেওয়া আর এর জন্য দরকার হয় বড় উইং কিংবা বড় পাখা। যাতে খুব সহজে বাতাসে মুভ করা যায় কিংবা যে কোন সাইডে টার্ন করা যায়।
২। বিমান বাহিনীর A-10: গ্রাউন্ড এট্যাকের জন্য ছোট উইং কিংবা ছোট পাখা বিশিষ্ট জেট যা খুব ছোট টার্গেটকে ফোকাস করা জন্য দরকার হয়। তাই এর পাখা গুলো খুব ছোট সাইজের হয়।
৩। নৌবাহিনীর F/A-1 সুপার হর্নেটঃ এটা ক্যারিয়ার এয়ারক্রাফট, বেশি গোলাবারুদ নিয়ে টেকঅফ এবং ল্যান্ড কারার ক্ষমতা রয়েছে। যার জন্য তার ডিজাইনে এক্সট্রা ওজন বহন করার মত জায়গা থাকে এবং বডি খুব স্ট্রং হয় ।
৪। মেরিনের হ্যারিয়ারঃ যে কোন এয়ারক্রাফটের রানওয়ে দরকার হয় কিন্তু এই এয়ারক্রাফট হেলিকপ্টারের মত মাটিতে ল্যান্ড করতে পারে। এর জন্য কোন রানওয়ে দরকার হয় না। পাহাড় কিংবা মাটিতে এটা সোজা ভাবে ল্যান্ড করতে পারে।
এখন এই প্লেনগুলো সম্পর্কে আপনার বিস্তারিত না জানলেও চলবে, কেননা কিছুটা আইডিয়া পেয়েছেন যে, বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে একটার সাথে আর একটার কোন মিল নেই। এগুলো প্রত্যেকটি এক এক বিষয়ে পারদর্শী। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সব গুলো ফিচার নিয়ে কিভাবে একটা জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার বানানোর চিন্তা করলো যা এক কথায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। ফাইটার টার নাম F35 জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার। এটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এটা বানাতে যেমন খরচ হয়েছে তেমনই সময়ও লেগেছে। ফিচার ক্রিপের লুপে পরলে যা হয় আর কি যত দিন যাচ্ছে এর মূল্য বেড়ে চলছে সাথে সাথে এর সময়। আর এটি বানানোর পর দেখা গেল এটির রয়েছে অনেক বাগ, পারফরমেন্স এবং ইউজেবেলিটি প্রবলেম। একজন সমালোচক বলেছিলেন “F-35 ঘুরতে পারে না, উঠতে পারে না, দৌড়াতে পারে না!” ওনার মতে, ডিজাইন অবজেক্টিভ মেজারমেন্টের ভাষায় এটি ব্যর্থ ডিজাইন অথবা ডিজাইন এরর, কারণ এক সাথে অনেক ফিচার দিতে গিয়ে কিছু জিনিস বাদ দিতে হয়েছে যা একটি এয়ারক্রাফট কে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে না এটা আসলে ফাইটার এয়ারক্রাফট। কারণ আপনাকে যদি শত্রুর পিছনে পিছনে ছুটতে হয় তাহলে বড় পাখা লাগাবে আর গ্রাউন্ড এ্যাটাক করতে হয় তাহলে ছোট পাখা লাগবে আবার যদি অনেক গোলা বারুদ বহন করতে হয় তাহলে বিমানের ওজন বাড়াতে হবে সোজা কথা এটার এক একটা ফিচার অন্য একটা ফিচারের বিপরীত। কিন্তু তারপর ও এটা বানানো হয়েছে এবং দেশ গুলোর কাছে বিক্রি করেছে তাহলে কি আমারা অনেক ধরে নিতে পারি এমন প্রোডাক্ট ও চলতে পারে? এরা কারা, আসে কোথা থেকে যে এই সব প্রোডাক্ট কিনতে চায়। সেটার উত্তর দিচ্ছি কেন চলছে কিংবা কেন কিনছে, তার আগে একটু বোঝানোর চেষ্টা করি ফ্লেক্সিবিলিটি-ইউজেবেলিটি ট্রেডঅফ কি?
ফ্লেক্সিবিলিটি-ইউজেবেলিটি, সহজভাবে বলতে গেলে, একটি ডিজাইনের ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ার সাথে সাথে ডিজাইনের ব্যবহারযোগ্যতা এবং পারফরম্যান্স কমে যায়। ফিচার ক্রিপের সাথে মিল পাচ্ছেন তাই তো। কিন্তু কেউ যদি ফিচারগুলোকে সঠিক ভাবে তার প্রোডাক্টের সাথে যুক্ত করে এবং সেটার ইউজেবেলিটি ঠিক রাখতে পারে তখন সেটাকে ফ্লেক্সিবিলিটি-ইউজেবেলিটি ট্রেডঅফ বলা যায়। মোদ্দা কথা দুইয়ের সমন্বয়ে কার্যক্ষমতা ঠিক রেখে প্রোডাক্ট বানানো। এখানে এত গুলো ফিচার নিয়ে এর ফ্লেক্সিবিলিটি এবং ইউজেবেলিটির ভারসাম্য ঠিক রাখাটাই হবে প্রথম চিন্তা। আবার সেই আর্মি সুইচ নাইফের উদাহরণ দিতে হয়, ধরুন, আপনি পিকনিক করতে যাবেন এখন আপনি ছোট্ট একটা বাকপ্যাক নিলেন। তার ভিতর আপেল, আগুন জ্বালানোর জন্য লাঠি এবং একটা কাচের সফট ড্রিঙ্কসের বোতল। এখন আপেল কাটার জন্য কি আপনি বড় ছুড়ি নিবেন? নাকি লাঠিগুলো কাটার জন্য করাত নিবেন? নাকি বোতল ওপেনার নিবেন? এখানেই আর্মি সুইচ নাইফ মূল্যবান।
প্রয়োজনের ভিত্তিতে কাস্টমাররা অনেক সময় এক সাথে অনেক ফিচার থাকাকে বেস্ট প্রোডাক্ট ভাবতে পারে এবং মাঝে মাঝে তাদের কাজের জন্য সিঙ্গেল এক্সপার্ট প্রোডাক্টের চাইতে মাল্টিটুলস টাইপ প্রোডাক্টের দরকার বেশি হয়। তাহলে এইসূত্র ধরে বলতে পারি, F35 জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার সাকসেসফুল? ভারি অস্ত্র, হেলিকপ্টারের মত ল্যান্ডিং এবং সহজে শত্রু টার্গেট করার সুবিধা পেলে তো যুদ্ধক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো হবে! তাই এর চাহিদা আছে এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধের মার্কেটে এটির ডিমান্ড আছে।তাই বেচা-বিক্রিও হচ্ছে।
কিন্তু না, ফ্লেক্সিবিলিটি-ইউজেবেলিটি ট্রেডঅফ মেথডে একটা প্রোডাক্টের সাকসেস রেট ৫টি প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে অনুমান করা হয়। আর এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর যদি বেশি “না” হবে তত বেশি প্রোডাক্টির সাফল্য অর্জন করার ক্ষমতা কমতে থাকে।
প্রশ্ন গুলো অনেক টা এমনঃ
১। আপনি যে ফিচারগুলো যোগ করবেন সেগুলো যথেষ্ট কিনা?
২। পারফরমেন্স সব সময় একই থাকে কিনা। ব্যাপার টা এমন যে অনেক ফিচারের কারণে প্রোডাক্টের মুল কাজের যে পারফরমেন্স সেটাই দিনশেষে ঠিক মত কাজ করছে না?
৩। ফিচার গুলো সমষ্টি এবং একজন ব্যবহারকারীর প্রয়োজনীয়তা একই রকম কিনা?
৪। ফিচারগুলো মডুলারাইজড কিনা অথবা নিজের ইচ্ছে মত আমি কাস্টমাইজ করতে পারবো কিনা?
৫। ফিচারগুলো পারফরমেন্সে নতুন কোন ভ্যালু যোগ করবে কিনা?
উপড়ের প্রশ্ন গুলোর উত্তর যদি F35 জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটারের সাথে মিলিয়ে দেখি তাহলে দেখবো যে গ্রাউন্ড এট্যাকের জন্য এর পাখা ছোট করতে হয়েছে তাই এটা সহজে টার্ন করা যায় না। এবং যে কোন দিকে টার্ন করানোর জন্য পাখা পরিবর্তনও করা যায় না। তাই ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ার সাথে সাথে ডিজাইনের ব্যবহারযোগ্যতা অথবা পারফরম্যান্স কমে গিয়েছে।
তাহলে কি পৃথিবীতে এমন কোন প্রোডাক্ট নেই, যা ফিচার ক্রিপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে? আছে, আপনার পকেটেই আছে! মোবাইল ফোনকে চিন্তা করুন… বিশাল বড় একটা ভারি ক্যামেরাকে আপনার পকেটে পুরে দিয়েছে, সাউন্ড সিস্টেম থেকে শুরু করে কমিউনিকেশন সিস্টেম সব কিছুই আছে। শুধু মোবাইল বলবো না, এখনকার স্মার্ট ওয়াচ- কম্পিউটার, বলতে গেলে ম্যাক্সিমাম টেক ইন্ডাস্ট্রির প্রোডাক্ট গুলো এমন হচ্ছে।
আপনি যখন কোনো বড় প্রোজেক্ট নিয়ে চিন্তা/কাজ করবেন তখনই ফ্লেক্সিবিলিটি এবং ইউজেবেলিটি এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়।তবে এই দুই ডিজাইন প্রিন্সিপাল চিন্তা করে আপনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশের কাজ শুরু করতে পারেন। সবার আগে আপনার গ্রাহকদের চিহ্নিত করুন তারপর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারকারীদের অগ্রাধিকার দিন। এখানে ব্যবহারকারীদের কে ৪ টি ভাগে ভাগ করুন –
ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ানোর জন্য আপনার প্রোডাক্টের একেবারে কী প্রয়োজন তা যোগ করবেন প্রথম ভাগের ব্যবহারকারীদের কথা মাথায় রেখে। পরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারকারীদের নিয়ে চিন্তা করতে পারেন এবং তাদের প্রয়োজন যোগ করতে পারেন। এই ভাবে তৃতীয়-চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিন্তা করতে পারেন।
সবশেষে, আপনি ডিজাইনে এমন কিছু যোগ করতে পারেন যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারকারীদের ইউজেবেলিটি কমাবে না এবং আপনার দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারকারীদেরও সমস্যা হবে না। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপটি এমন বৈশিষ্ট্যগুলি পাবে যা সেরা তবে এর ফিচার গুলোর ব্যবাহার খুব কম হয় এবং চতুর্থ ব্যবহারকারীরা জন্য এমন ফিচার যুক্ত করতে পারেন যা দেখেই সান্ত্বনা খুঁজে পায়। তবে অবশ্যই প্রথম ব্যবহারকারীদের ইউজেবেলিটি যেন না কমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এ সব ক্ষেত্রে উপরের ৫টি প্রশ্ন করুন। যদি কোন একটি উত্তর “না” হয়, সেটাকে “হ্যাঁ” করার চিন্তা করুন। কারণ শুরুতেই বলেছিলাম জ্যাক অফ অল ট্রেড আর এর তকমা পেতে হলে আপনাকে খুব কমপ্লেক্স ডিজাইন সিস্টেমের ভিতর থেকে যেতে হবে। যেখানে আপনার ডিজাইন, ফিচার ডিসিশান এবং কোনটার সাথে কি মার্জ করবেন সেটা সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকে। মাস্টার অফ নান না হলেও চলবে। কারণ একটা মোবাইলকে যদি চিন্তা করি আর প্রশ্ন করি, এটা কোন বিষয়ে এক্সপার্ট? উত্তর অনেক পাবো কিন্তু একই উত্তর পাওয়াটা কষ্টকর হতেও পারে কারণ সবার ব্যবহার এক নয়।
তাই F35 হোক, কিংবা মোবাইল হোক, মনে রাখবেন “জ্যাক অফ অল ট্রেড, মাস্টার অফ নান” এটা কোন ব্যঙ্গাত্মক ব্যাপার নয়, বরং এটা একটা “ল”।আর আপনার পণ্য সকলের জন্য নাও হতে পারে, আবার হতেও পারে কিন্তু কিভাবে বানাবেন সেই সিদ্ধান্ত আপনার।
লিঙ্ক বৃত্তান্তঃ
Book: Universal Principal of Design
https://en.wikipedia.org/wiki/Flexibility%E2%80%93usability_tradeoff
Have an idea or just want to connect?
RISAT RAJIN © 2025
Designed by me, powered by ✦ Droip