09-06-2022
ভাই আমি ইম্পোস্টার সিন্ড্রোম ভুগছি? আমি আধ খাওয়া চা টা ফেলে দিয়ে তার দিকে অবাক ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিচারে কিভাবে আসলেন? জি বলুন আমি শুনছি। সে বলতে লাগলো, ভাই নিজের কাজ দেখাতে কেমন জানি লাগে, মনে হয় ভালো হয় নি। ৬ বছর ধরে ডিজাইন করছি এখন পর্যন্ত কোথাও ডিজাইন দেই না, আসলে দিতে পারি না। লোকে কি বলবে, আলতু ফালতু কমেন্টে সয়লাব হবে। সারা দিন বই পড়ি, ডিজাইন গ্রুপে যত বই শেয়ার হয়েছে সব পড়েছি। ঢাকার যত গুলো ওয়েবইনার, সেমিনার, অনলাইন-অফলাইন কোর্স হয় সেগুলো করেছি তারপর ও মনে হচ্ছে কিছু পারি না। কি করবো বুঝতে পারছি না, এটা নিয়ে অনেকের সাথে কথা বলেছি। বাংলাদেশের বড় বড় ডিজাইনাররা যা করে, যা বলে সব ফলো করি। কিন্তু মনে হচ্ছে আটকে আছি। … ব্লা ব্লা
আমি কথা গুলো শুনছিলাম, নিজের সাথে মানুষ টা কি যুদ্ধ করছে। চোখ গুলো ঝিকমিক করার কথা, সেখানে হতাশার ছাপ। ক্যারিয়ার টা পারফেক্ট করার কি আপ্রাণ চেষ্টা মাইরি। আমি একটু চুপ মেরে গেলাম, এই জন্য যে এই ট্র্যাপে আমি ও পরেছিলাম। শুধু পার্থক্য তার বলার মানুষ আছে, আমার ছিল না। এটা একটা আত্নহনন টাইপ জিনিস।
আমি ডিজাইন লাইনে এসেছিলাম কারণ ছোট বেলায় টাই পরে বাবার মত বিজনেস কিংবা জব করার যে অসহ্য রুলস, রেগুলেশান মেইনটেইন করা, তা যেন না লাগে। আসল কথা স্বাদ হীন যেন জীবন না হয়। যেখানে আনন্দ থাকবে, সৃষ্টি করার একটা প্রেরণা থাকবে, অলস্য থাকবে, আবার শরীরটাকে ঝেরে নতুন ভাবে শুরু করবো, হাল্কা টাকা থাকবে, ইত্যাদি। বই পড়বো ইচ্ছে নিয়ে, স্কুলের লিস্টেড করা বই পড়ার মত না। ভিডিও দেখবো লিক হওয়া নিউজ শুনে, রোবেটের মত টাইপ না।
কিন্তু ঠিক সেই মানুষ টার মত এই ডিজাইনার সমাজ একটা সময় আমার ব্রেন ওয়াশ করতে বাধ্য করেছে, এক দিনে এই এই বই খতম করতে হবে, কোর্স করতে হবে, সেমিনার গুলোতে সেলফ মার্কেটিং লাইন গুলো, মোটিভেশনের মত গিলতে হবে। এক ভাই ওই ডিজাইনারের তাবিজ নিয়েছে। আজ সে সেটা ফলো করে ইউরোপের একটা কোম্পানির রিমোট কন্ট্রোল চালায়, তার কাজ ফলো করো। ড্রিবল, বিহ্যান্স এর মত ড্রেস পড়তে হবে কারণ এটা ট্রেন্ড। নিজেকে রুল এবং রেগুলেশনের ভিতর আটকে রাখো। পথ খুব কঠিন, সহজ বলে এই লাইনে কোন কথা নেই। আজকে এই সেমিনারে ঐ ভাইয়ের পা ধোয়া পানি বিতরণ করা হবে, তাই যেতে হবে। আরও কত আণ্ডা পাণ্ডা প্যাঁচাল। বিশ্বাস করুন আমিও এগুলো গিলতে শুরু করলাম এবং করলামও। মনে হলো আমি জীবনের পিক পয়েন্টে পৌঁছে গেছি।
মানুষ অনেক কষ্টে অনুকরণ করে, একবার অনুকরণ করতে পারলে সেখান থেকে বের হতে পারে না , যদি না অন্য কোন অনুকরণ করার পরিবেশ পায়। এখন সমস্যা হলো গিয়ে যেখান থেকে অনুকরণ করেছিল সেটা হয় মরে গিয়েছে কিংবা তার রূপ পরিবর্তন করেছে কিন্তু আমি তো আর পরিবর্তন করতে পারছি না আর তখন ই মন বলে উঠে আমি ইম্পোস্টার সিন্ড্রোমে ভুগছি। কারণ অন্যের কথা পড়তে আর শুনতেই সময় চলে গেছে নিজেকে আর জানা হয়নি।
যাক এটা তো গেল ঘটনা, এখন এটার ইফেক্ট বলি। এই সময় টাতে মানুষ খুত খুত হয়ে যায়। মনে হচ্ছে কিছু ভালো হচ্ছে না। ট্রেন্ডের সাথে মিলছে না কিংবা অমুক তমুক ভাইদের কাজের কাছে আমার কাজ নস্যি লাগছে। এক সাথে ক্যরিয়ার শুরু করা ভাই আজ কই চলে গেছে, আর আমি কই পরে আছি। এগুলো দেখে মন বিশ্বাস করে নেয় যে তাকে দিয়ে কিছু হবে না। সে তখন নিজেকে গুটিয়ে নেয়, কারণ সে হতাশার ছোঁয়া পেয়েছে। আর গুটানোর কারণ একটা শূন্যস্থান তৈরি হয় আর তখন সেই শূন্য স্থান পূরণ করার জন্য উঠে পরে লাগে লাইফ অথবা কাজকে পারফেকশন করার জন্য। মনে কে সান্ত্বনা দেয় “ বাঘ যখন শিকার করে তখন দুই কদম পিছায় এর মানে এই না যে সে পিছনে পরেছে” আরও কত কি? ব্যাস, যে ডিজানারটা তার ডিজাইন দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি কাঁপাতে পারতো সে এখন লাইফ ইজ অ্যাঁ রেস এই টাইটেলে চাপা পরে যায়। নিজেকে ঘোড়া ভাবা শুরু হয়, ডিজাইন বাদ দিয়ে দৌড়ানোর প্রাকটিস শুরু করে।
এতক্ষণ বলছিলাম আমার আর সেই ছেলেটার গল্পের একটা সারংশ।
আপনারা এবার বলবেন, আপনি কি তাহলে বলতে চাচ্ছেন এই গুলো ফলো করা খারাপ, এগুলো সাকসেস এর চাবিকাঠি না।
হতে পারে কিন্তু আমার কাছে সেটা একটা পথ মাত্র, আরও পথ আছে। এই পথ যে সবার জন্য কোভিড টিকার মত কাজে দিবে ব্যাপারটা কি তা? এক একজনের জন্য এক এক পথ। এবার একটু বুক ভরে নিশ্বাস নিন। এই ক্যারিয়ার টা আনন্দের। নিজের উপর জোর করা বন্ধ করুন। অন্যের ডিজাইন থিওরি ফলো করতেই হবে এমনটা না। আমার মতে নিজের মনের উপর জোর খাটিয়ে ডিজাইন ক্যারিয়ার হয় না। জোড় করে বই পড়তে না চাইলে ভিডিও দেখুন। ভিডিও দেখতে ভালো না লাগলে অডিও বুক শুনুন। কেস স্টাডি লিখতে না চাইলে শর্ট করে লিখুন বিশাল আর্টিকেল লেখার দরকার নেই, অন্যের বানানো প্রসেস ফলো করতে না চাইলে নিজের মত করে সাজিয়ে নিন। মোদ্দা কথা অন্যেকে দেখে নিজের ক্যারিয়ারেকে পারফেক্ট করার যে যুদ্ধ নেমেছেন , মনের বিপরীতে গিয়ে সেটা কে বাদ দিয়ে একটু নিজের মত সাজিয়ে নিন। সেই বিশাল বড় কেইস স্টাডি দিয়েছে আপনাকেও দিতে হবে এই অন্যায় বিচার নিজের উপর কেন করছেন। ক্যারিয়ার পারফেকশন বলে কোন কথা নেই। এটা একটা ট্র্যাপ, আর এই ট্র্যাপ থেকে বাঁচতে ব্যাল্যান্স করে চলতে হয়, একক বলে কোন শব্দ নেই এখানে। নিজেকে ছাড় দিতে হয়। কখন ধরবেন আর কখন ছাড়বেন একটু প্রকাটিস করে দেখুন না।
এই লেখাটা হয় তো ৫-১০ মিনিটে পড়তে পারবেন, কিন্তু আমাকে এই ট্র্যাপ থেকে মুক্তি পেতে বছর লেগেছে। এই লেখাটা তাদের জন্য যাদের এমন মনে হয় যে তারা এই সিন্ড্রোমে আহত। তাদের জন্য না যারা এভাবে ভেবে দেখেনি, কিংবা তাদের গায়ে এর আঁচর পরেনি। আপনি তাহলে অনেক ভাগ্যবান ভায়া। আর আমার কাছে এই সিন্ড্রোমটা অনেক টা সুইসাইডের মত। কারণ এখানে ডিপ্রেশান থাকে আর এই ডিপ্রেশান যে কত খারাপ সেটা নতুন করে হয়তো বুঝাতে হবে না। তবে ডিপ্রেশান আনান্তা জ্বলিলের সেই ডায়লগের মত “মৃত ডিজাইনার কে কখন ডিজাইন করতে দেখেছো”।এই সিন্ড্রোমে ধুঁকতে থাকা ডিজাইনার আসলেই মৃত। তাই আপনি অতি সত্তর কোন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করুন, যে আপনাকে বুঝতে পারে এবং যে এই ট্র্যাপ থেকে আপনাকে বের করতে পারবে। তা না হলে ব্রেক দিন, আর আমার কথা পছন্দ না হলে নিজে আইডিয়া বের করুন, নিজে ট্রাই করুন। পারবেন মনে হচ্ছে কারণ হাস পাড়ে, মুরগী পাড়ে, আপনি ও পারবেন। অল দ্যা বেস্ট।
ভুলভ্রান্তি থাকলে ক্ষমা করে দিবেন। আমি এটা নিয়ে বিতর্ক করতে চাই না। তাই কোন বিতর্কতে জড়াবো না। রাজিন’২২
Have an idea or just want to connect?
RISAT RAJIN © 2025
Designed by me, powered by ✦ Droip